কারণে-অকারণে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, মানুষ তাদের মূল বাসস্থান থেকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং জনসংখ্যাগত সংকটের কারণে সাধারণত এই ধরনের অভিবাসন ঘটে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ এবং সামাজিক উন্নয়নের সুবিধাগুলো ব্যবহার করার জন্য মানুষ শহরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। দরিদ্র পরিবারের মধ্যে অভিবাসনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি, যার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই গ্রামে বাস করে। গ্রাম থেকে অনেকেই, বিশেষ করে তরুণ বয়সীরা শহরাঞ্চলে অর্থনৈতিক সুযোগ এবং কাজের সুবিধা উপভোগ করার আশায় শহরে আসে।
বাংলাদেশের প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়। অন্যদিকে, উচ্চ চাকরির সুযোগ, উচ্চ মজুরি, উন্নত জীবিকা, উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুবিধা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কম ঝুঁকি হলো অভিবাসনকে অনুপ্রাণিত করার গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
শহরে আসা নিম্ন আয়ের এসব পরিবারগুলো আশ্রয় নেয় বস্তিতে। সেখানকার জীবনমান অত্যন্ত নিম্নমানের। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মেলবন্ধন হয় না। শুরু হয় নগরে টিকে থাকার লড়াই। এতকিছুর পরেও বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, তাদের স্কুলে পাঠান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় লেখাপড়া করে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে স্কুলগামী শিশুর হার জাতীয় হারের ৮৫.০ শতাংশ। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়া ছেলেদের হার ৮২.৫ শতাংশ এবং মেয়েদের হার ৮৭.০ শতাংশ [১]। শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১ এর তথ্য অনুসারে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলের সংখ্যা ৬৮৪টি যেখানে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬ লক্ষ ৯ হাজার ৪৫৮ জন। অপরদিকে প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যা ২০ হাজার দুইশত ৭৬টি। আর প্রাইভেট স্কুলে ছাত্রছাত্রী আছে মোট ৯৫ লক্ষ ৮০ হাজার পাঁচ শত ৬৪ জন [২]।
শিশুর শিক্ষা লাভের জন্য সুস্বাস্থ্য, অত্যন্ত জরুরি। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ একজন শিশু শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ঝরে পড়া রোধে এবং এবং শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সরকার, প্রাথমিক শিক্ষায় দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা জরুরি বলে উল্লেখ করে। পিছিয়ে পড়া এলাকাসহ গ্রামীণ সব বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবার ব্যবস্থা চালু করা হবে বলে জানানো হলেও পরবর্তীতে নগরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়ও এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয় [৩]।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সরকার জুলাই ২০২৩ থেকে আবার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চালুর পরিকল্পনা করছে। এই মিড-ডে মিল শিশুদের স্কুলেই দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ নিশ্চিত করবে [৪]।
এটা অবশ্যই অনেক আশাব্যঞ্জক কথা। তবে জনবিস্ফোরণের এই দেশে সব শিশুই তো আর সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় না। সেক্ষেত্রে তাদের মিড-ডে মিলের সুযোগ থাকে না। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, শিশুরা স্কুলের আশপাশ থেকে প্যাকেটজাত, অতিরিক্ত লবণ সমৃদ্ধ খাবার অথবা কৃত্রিম রং ও প্রিজারভেটিভে তৈরি পানীয়ও কিনে খায়। যা তাদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এবার দেখা যাক, মাধ্যমিক স্তরের শিশুদের কী অবস্থা। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেসব শিশুরা বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ক্যান্টিন থাকে না। আর থাকলেও সেখানে বিক্রি হয় জাঙ্কফুড। ফলে বাধ্য হয়ে তারা সেইসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর এই বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থাকছে নিষ্ক্রিয়।
শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় টয়লেটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস শিশুকে স্বাস্থ্যকর জীবন ও ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলে। টয়লেট ব্যবহারের পর তা অপরের জন্য উপযোগী করে রাখা এবং সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার জন্য বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি ও অধিক সংখ্যক টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতে হয়।
বাংলাদেশ সরকার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ২০১৫ সালে সব জেলা এবং উপ-জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। বিজ্ঞপ্তিতে স্কুলের টয়লেটগুলোর উন্নতির জন্য বলা হয়েছিল, যার মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক টয়লেট তৈরি করা, সাবান, পানি এবং বর্জ্য বিনের ব্যবস্থা করা এবং ঋতুস্রাব সম্পর্কে স্কুলছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়।
২০১৪ বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন থেকে জানানো হয়েছিল যে দেশব্যাপী মাত্র ৬ শতাংশ স্কুল ঋতুস্রাবের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করে। প্রতি পিরিয়ডে গড়ে তিনদিন অনুপস্থিত ধরে, ৪১ শতাংশ মেয়ে তিন মাস স্কুলে অনুপস্থিত ছিল। তবে বিজ্ঞপ্তির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে সীমিত আকারে। জাতীয় হাইজিন সার্ভে ২০১৮তে দেখা গেছে যে ৩০ শতাংশ কিশোরী স্কুল ছাত্রী তাদের পিরিয়ডের সময় স্কুলে অনুপস্থিত ছিল। তার মানে গড়ে প্রতি পিরিয়ডে ২.৫ দিন অনুপস্থিত [৫]।
বেশকিছু পরীক্ষা প্রমাণ করেছে যে মানুষের খাদ্যের সাধারণ পুষ্টি এবং খাদ্য উপাদান উভয়ই মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের মধ্যে রয়েছে—মস্তিষ্কের বিকাশ, মস্তিষ্কে সংকেত নেটওয়ার্ক, নিউরোট্রান্সমিটার, জ্ঞান এবং স্মৃতি [৬]।
তার মানে, ক্লাসের পড়ায় মনোযোগী হতে গেলেও খাবার দরকার। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ সময় অনাহারী শিশুর মস্তিষ্কে সংকেত পৌঁছাতে দেরি হয় বলে সে ক্লাসে অমনোযোগী থাকে। এক্ষেত্রে যদি বেসরকারি স্কুলগুলোয়ও মিট-ডে মিলের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ভালো হয়।
স্কুল ক্যান্টিনগুলো অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি না হয় সেটা দেখভালের দায়িত্বও স্কুল কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। প্রায়শই কিশোরী মেয়েরা স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে অভিযোগ করে বলে, সেখানে পরিষ্কার এবং পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা, পানি, সাবান এবং বর্জ্য ফেলার বিনের অভাব রয়েছে। এই কারণে স্কুলে তাদের ঋতুস্রাবের সময়কালীন উপকরণ পরিবর্তন করা কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অনেক মেয়েরা এই কারণে তাদের ঋতুস্রাবের সামগ্রী পরিবর্তন করার জন্য বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বা অধিক রক্তপাতের দিনগুলোয় স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। আবার ঋতুস্রাবের কারণে তাদের ইউনিফর্ম বা স্কুলের বেঞ্চে দাগ পড়লে শিক্ষক এবং অন্যান্য ছাত্রদের কাছ থেকে উপহাসের ভয়ে তারা স্কুলে আসে না।
কিশোরদেরও শ্রেণিতে এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা উপহাস করা থেকে বিরত থাকে। স্কুলগুলোয় কিশোরী বান্ধব টয়লেট থাকা আবশ্যক। সকল শিশু আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠুক, স্কুল যেন কোনো শিশুর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে না যায়।
লেখক : ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট।