বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৫ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গণমাধ্যম সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে : তথ্য উপদেষ্টা সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি রোধে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর করে অধ্যাদেশ পৃথিবীর সুরক্ষায় ‘জিরো কার্বন’-ভিত্তিক জীবনধারার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বেক্সিমকো ফার্মায় রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত গাজা-লেবাননে ইসরায়েলি ‘হত্যাযজ্ঞ’ অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান সৌদি যুবরাজের সরকারের তিন মাস পূর্তি : তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য অর্জন আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বিদেশের মাটিতে আওয়ামী দুষ্কৃতকারীদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে আইনজীবীদের প্রতিবাদ চট্টগ্রামে হাছান মাহমুদ ও নওফেলসহ ৬০ জনের নামে মামলা রাজধানীতে মিছিল : নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ৫৫ নেতাকর্মী কারাগারে আজারবাইজানের উদ্দেশ্যে যাত্রা প্রধান উপদেষ্টার মোহাম্মদপুরে প্রবাসীর বাসায় হামলা ও মারধরের অভিযোগ আরও ১১৮ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে

শেকড়ের টানে বাঙালির পাশে

জাকির হোসেন
আপডেট : বুধবার, ২০ মার্চ, ২০২৪, ৭:৩০ অপরাহ্ন

একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিন। সারা ভারতের লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ‘মানবিক বোধ’ এর টানে। তবে অনেকের হৃদয়ে এই বোধের সঙ্গে ছিল মাটি ও শেকড়ের টান। তাদের কয়েকজনকে নিয়ে এ লেখা।
রুমা গুহঠাকুরতা: একাত্তরে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতার জন্য দিল্লির পথে পথে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। ট্রাকে একদল শিল্পীকে নিয়ে দিল্লির বিভিন্ন সড়কে গান গেয়ে অর্থ তুলতেন তিনি। তাদের ট্রাকের সামনে বাঁধা থাকত কালো কাপড়ের ওপর সাদা হরফে লেখা ব্যানার ‘ইস্ট বেঙ্গল ইজ ব্লিডিং’। প্রথম দিনই দিল্লির মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অর্থ সংগ্রহ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। মুক্তিকামী শরণার্থীদের সহযোগিতায় এ টাকা দিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণ তহবিলে।
রুমা গুহঠাকুরতা মুক্তিযুদ্ধের সময় এভাবেই বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য দিল্লিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অনুষ্ঠানটি হয় দিল্লির বিজ্ঞান ভবন হলে। এ অনুষ্ঠানে রুমা গুহঠাকুরতা পরিবেশন করেন দেশাত্মবোধক গান, স্বাধীনতার গান, মুক্তির গান। তার গান শুনে ইন্দিরা গান্ধী মুগ্ধ হন। অনুষ্ঠান শেষে ইন্দিরা গান্ধীর নীতিনির্ধারক পিএন হাকসারের কন্যা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য তাকে দিল্লির রাস্তায় গান গাওয়ার অনুরোধ করেন। এতে তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হন। এ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম অংশ নিয়েছিলেন।

 

 

শুধু রাজধানী দিল্লি নয়, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকার পথে-প্রান্তরেও গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন রুমা গুহঠাকুরতা। সহযোগিতা করেছেন শরণার্থী শিবিরের ভারতীয় মেডিকেল টিমকে। শরণার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য সুদূর যুক্তরাজ্যেও কয়েকটি অনুষ্ঠানে গান করেন তিনি। লন্ডনের প্রাচীন হল স্যাডলার্স ওয়েল থিয়েটার, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি ও সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতেও অনুষ্ঠান করেন। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক তহবিলে। লন্ডনে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে গান গেয়েছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, সবিতা ব্রত দত্ত এবং বাংলাদেশের তিনজন শিল্পী। রুমার অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়েছিলেন প্রখ্যাত তবলা বাদক রাধা কান্ত নন্দ ও চন্দ্র কান্ত নন্দী। লন্ডনে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন প্রবাসী ভারতীয় বীরেন্দ্র শংকর। এই বীরেন্দ্র শংকর বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।
রুমা গুহঠাকুরতার বাবা সত্যেন ঘোষ এবং মা সতী ঘোষ সংস্কৃতি জগতের মানুষ ছিলেন। মা ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী। এইচএমভি সতী দেবীর কণ্ঠে প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের করে। রুমার সত্যেন ঘোষ ছিলেন সাংবাদিক। রুমা নিজেও একসময় ইংরেজি পত্রিকায় লিখতেন।
রুমা গুহঠাকুরতার পৈতৃক নিবাস যশোর। মায়ের বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী। কিশোর কুমারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বিয়ে করেছিলেন বরিশালের বানারীপাড়ার গুহঠাকুরতা পরিবারের অরূপ গুহঠাকুরতাকে। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা।
২০১৯ সালের ৩ জুন সকাল সোয়া ৬টার দিকে কলকাতায় নিজের বাড়ি ৩৮ বালিগঞ্জ প্লেসে ঠাকুরতা হাউসে ঘুমের মধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বর্ষীয়ান অভিনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতা। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় : একাত্তরে বাঙালি শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন উপমহাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিতেন। পাশাপাশি এসব অসহায় মুক্তিকামী মানুষের মুখে একটু অন্ন তুলে দিতে তিনি সুশীল মজুমদার, তুলসি লাহিড়ী, তৃপ্তিমিত্রকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার সড়কে চাঁদা তুলতেন। সেই চাঁদা তুলে দিতেন উদ্বাস্তু ত্রাণ তহবিলে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। শৈশব কেটেছে ঢাকার কমলাপুরে। বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রেলের স্টেশন মাস্টার। তার কর্মস্থল ছিল ফুলবাড়িয়ায়, যেখানে ছিল ঢাকার পুরোনো রেলস্টেশন। সাবিত্রীরা ছিলেন ১০ বোন। কোনো ভাই ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তারা ভারতে চলে যান। এর আগে দুই বোনকে তাদের বাবা কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। উঠেছিলেন দিদির বাড়ি কলকাতার টালিগঞ্জে। চিরকুমারী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অবসরের সঙ্গী বই। উপন্যাসেই বেশি আনন্দ পান।
মৈত্রেয়ী দেবী: মৈত্রেয়ী দেবী ‘নবজাতক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতকে যুদ্ধ করা উচিত বলে প্রবন্ধ লেখেন। এই পত্রিকায় অন্নদাশঙ্কর রায় ‘বন্দেমাতরম’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি ভারতকে যুদ্ধে না জড়ানোর পক্ষে অভিমত প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ দিতে পারি, অস্ত্র দিতে পারি, কিন্তু সৈন্য পাঠাব না। সৈন্য পাঠানোটা হবে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাই না।’
মৈত্রেয়ী দেবী তৎক্ষণাৎ অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই মতের বিরোধিতা করেন এবং তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যুদ্ধের সপক্ষে কলম ধরেন। শুধু কলম ধরেই তিনি ক্ষান্ত হননি। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করেন। এই সময়ে তিনি কলকাতা থেকে ২৪ মাইল দূরে বাদু নামক গ্রামে একটি ৯ বিঘা জমিজুড়ে কৃষি, মাছ চাষ, মধু চাষ, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরের অনাথ শিশুদের জন্য ‘খেলাঘর’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি এই সংস্থার দেখাশোনা করেন।
একাত্তরে মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে গৌরী আইয়ুব এবং অন্নদাশঙ্কর রায়ের সহধর্মিণী লীলা রায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
মৈত্রেয়ী দেবীর জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে। বাবা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও মা হিমানী মাধুরী রায়। বাবা ছিলেন একজন দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক। তার শৈশব কেটেছে বাবার বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়ার গৈলা গ্রামে। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৩৪ সালে তিনি ড. মনোমোহন সেনের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। মনোমোহন সেন ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। মৈত্রেয়ী দেবী বিয়ের পরেই স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন মংপু। ১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সুহৃদ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একাত্তরের মার্চে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের খবর পান সুদূর ভিয়েতনামে বসে। তখন তিনি আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে ভিয়েতনাম সফর করছিলেন। সেখানেই শুনতে পান নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা। বিষয়টি তিনি তৎক্ষণাৎ আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের নেতাদের জানান এবং মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে তাদের সমর্থন আদায় করেন। পরে তিনি দেশে ফিরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সভা-সমাবেশে একাগ্র হন। সংগঠিত করেন কলকাতার কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের। তিনি ছিলেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি’র সহ-সভাপতি। আর এই সংগঠনের অধিকর্তা বা সভাপতি ছিলেন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ও রাজনীতিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। সংগঠনটির অফিস ছিল লেনিন সরণিতে। এই সংগঠনের ডাকে একাত্তরের ৩১ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কলকাতায় বন্ধ পালিত হয়।
ভারত সরকারের ভূমিকা কী হবে, জাতীয় নীতি কীভাবে এগোবে, এসব কথা তখন তারা ভাবেননি। কলকাতার লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা অন্তর থেকেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে কলম ধরার তাগিদ অনুভব করেন। ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জগতে সচেতনতা বাড়াতে তারা অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখেন।
শিল্পী সাহিত্যিকদের ডাকে বন্ধ পালনের নজির খুব একটা নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের জন্য কলকাতার কবি-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের এই সমর্থন ছিল নতুন প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ যে একা না, ঘরের পাশেই যে আমাদের মিত্র আছে, এটি জানান দিয়েছিল কলকাতার ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি’। এই সংগঠনের হয়ে একাত্তরে কলম ধরেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, অমিতাভ দাশগুপ্ত, গোলাম কুদ্দুস, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজসহ আরও অনেকে।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে মতে, একাত্তরে তাদের মধ্যে যে বোধ তাড়িত করেছিল তাতে মানবিকতা ছিল রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী প্রকৃতপক্ষে হত্যা করছিল মানব সভ্যতাকে। এ জন্যই সবাই দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছিলেন।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের দর্শনায়। জন্ম ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে। শৈশব কেটেছে নওগাঁয়। নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যারা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষর-পরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তা প্রতিক্রিয়া ছিল এমন- ‘চোখের সামনে জ্বলছে আমার প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ। বাতাসে ভাসছে আমার ধর্ষিতা বোনের চিৎকার। দুই আঙুলে কান চাপা দিই। বানের জলের মতো সর্বহারা মানুষ আসছে এপারে, প্রাণ নিয়ে, সম্ভ্রম বাঁচাতে। কী লিখব আমি ভিয়েতনাম নিয়ে, আমার সামনে তো আরেক ভিয়েতনাম বাংলাদেশ।’
যকৃৎ ও হৃৎপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
গোলাম কুদ্দুস: কবি, সাংবাদিক ও রাজনীতিক গোলাম কুদ্দুস ছিলেন বিপ্লবী চেতনার মানুষ। তাই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় তিনি ঘরে বসে থাকেননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করেছেন। লিখেছেন কবিতা। জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে দিয়েছিলেন নৈতিক সমর্থন।
গোলাম কুদ্দুস মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাড়িতে কুষ্টিয়া এলাকার একটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সুরুজ ছিল ওই পরিবারের কর্তাব্যক্তি। একদিন সুরুজের তিন বছরের শিশুপুত্র অপহৃত হয়। বহু খোঁজাখুঁজির পর তাকে পাওয়া যায় একটি বস্তিতে। পরে ঘটনা জানাজানি হয়। যারা অপহরণ করেছিলেন তারা উর্দুভাষী অবাঙালি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি স্থানীয় বিধায়ক ডা. এমএ গনির হস্তক্ষেপে। ডা. গনিও ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
গোলাম কুদ্দুসের ফুপাতো ভাই ছিলেন বাংলাদেশের ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেন। এই সৈয়দ আলতাফ হোসেন একসময় ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজে কাজ করতেন। গোলাম কুদ্দুস তাকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
কবি গোলাম কুদ্দুস কলকাতার বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি রুমে  থাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ২৪ নং রুমে আর তিনি ছিলেন ২৩নং রুমে। বন্ধুত্বও ছিল দুজনের মধ্যে, যদিও দুজনে দুই কলেজের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজে) আর গোলাম কুদ্দুস ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের।
গোলাম কুদ্দুসের জন্ম ১৯২০ সালে ফরিদপুরের গোট্টিগ্রামে মামাবাড়িতে। নিজেদের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার ধলনগর গ্রামে। বাবা বিখ্যাত উকিল গোলাম দরবেশ জোয়ারদার আর মা সৈয়দুন্নেসা খাতুন। বাল্যশিক্ষা নিজ গ্রামের সোলেমান পণ্ডিতের পাঠশালায়। তারপরে হরিনারায়ণপুরে হাই স্কুলে। ম্যাট্রিক পাস করেন কুষ্টিয়া হাই স্কুল থেকে। এরপরের শিক্ষা কলকাতাতে। ইতিহাসে এমএ পাস করেন কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে।
গোলাম কুদ্দুস ২২ বছর বয়সেই ‘অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস’-এর যুগ্ম সম্পাদক হন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সঙ্গে। সাংবাদিকতা শুরু ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায়। এটি ছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখপত্র। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গোপনে পাঠানো হতো এই পত্রিকা। চল্লিশের দশকে ফ্যাসিবিরোধী কবিদের সংকলন ‘একসূত্র’ যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নাচে মনময়ূর, নবরামায়ণ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও উপন্যাস, গদ্য, প্রবন্ধ, রিপোর্টাজ লিখেছেন গোলাম কুদ্দুস। পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। ২০০৬ সালে কলকাতায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ কবি গোলাম কুদ্দুস।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: সবেমাত্র আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। খবরের কাগজে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর দেখে তিনি বিস্মিত হন। আর তখন তার মনে পড়ে জন্মভূমির কথা। প্রিয় জন্মভূমি তখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। তাই তিনি কিছুতেই বসে থাকতে পারেননি। সেদিনই তিনিও দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। নেমে পড়েন যুদ্ধে। লেখনী ছিল তার অস্ত্র। ওই সময় তার লেখা ‘১৯৭১’ কবিতাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। ওই সময়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘অর্জুন’ নামে একটা উপন্যাস লেখেন এবং উপন্যাসটি তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি প্রায়শই বনগাঁ আর সাতক্ষীরা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যেতেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে যেতেন ওষুধপত্র ও খাবার-দাবার। কয়েকজন শরণার্থীকে তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয়ও দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ার জন্য তিনি দিনের পর দিন সভা-সমাবেশ করেছেন। ওই সময়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন- শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী, দাউদ হায়দার প্রমুখ।
মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন গিন্সবার্গ। উঠেছিলেন সুনীলের বাড়িতেই। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ সড়ক ছিল ‘যশোর রোড’। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হওয়ায় তখন পানিতে ডুবে গিয়েছিল যশোর রোড। এ কারণে সড়কপথে যেতে না পেরে গিন্সবার্গ নৌকাযোগে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে আসেন। তার সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি লেখেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র। দুজনের বাড়িই ফরিদপুর। এ কথা জানার পর বঙ্গবন্ধু তাদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সেদিনের স্মৃতি জীবনের কোনো স্তরেই ভুলতে পারেননি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে। জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ২০১২ সালে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে পরিচিত ছিলেন।
২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছাতে দাহ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর