সাংগঠনিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের মনগড়া নিয়মে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের নামে এক বছরে তিনবার ভুয়া কমিটি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক দুই বিতর্কিত নেতা মো. নাজিম ও নোমান হোসাইন তালুকদারের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ উঠেছে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে বহাল থাকা বৈধ কমিটিকে বিতর্কিত করতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের নামে আবারও নতুন করে মাজেদ-লতাকে দিয়ে কমিটি দিয়েছেন নাজিম-নোমান। এই নিয়ে গত একবছরে একই কলেজে তৃতীয়বারের মতো নতুন কমিটি দেন বিতর্কিত এই দুই নেতা।
এক বছরে একাধিকবার কমিটি দেওয়ার বিষয়ে মো. নাজিম মিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বর্ধিত সভা করে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে।’ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বর্ধিত সভা করার এখতিয়ার আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো গঠনতন্ত্র নেই।’
নাজিম মিয়া বর্তমানে ঢাকার জজকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। একজন পেশাজীবী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদে থাকতে পারেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তো জজ কোর্টের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী না।’
এই কমিটিতেই সাধারণ সম্পাদক পদ দাবি করা নোমান হোসেন তালুকদারের কাছে ফোনে তাদের কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সেন্ট্রাল ল’ কলেজে এক বছরে তিন তিনটি কমিটি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্রপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রবীন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. লায়েকুজ্জামান মোল্লার কাছে নতুন করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ২০১৩ সালের পর বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদে কোনো ধরনের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি।
নাজিম ও নোমান ছাত্র সংগঠন করার এখতিয়ার হারিয়েছেন- এমন মন্তব্য করে লায়েকুজ্জামান বলেন, ‘এরা পেশাজীবী। কোনোভাবেই এরা বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের সদস্য হতে পারে না। তাছাড়া নতুন করে কাউন্সিল হয়নি। পেশাজীবী হওয়ায় তাদের আর ছাত্র সংগঠনে থাকার সুযোগ নেই। নাজিম-নোমান যদি নিজেদের সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক দাবি করে এর কোনো ভিত্তি নেই। তাদের কমিটি হবে সাংগঠনিক নিয়ম অনুসারে অবৈধ।’
একই কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, ‘একজন আইনজীবী কখনোই ছাত্র সংগঠনে থাকতে পারেন না।’
বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের বর্তমান সভাপতি মো. সেলিমুর রহমান সেলিমের কাছে বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের জাতীয় কাউন্সিল হয়েছি কি না- জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের পরে কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিল হয়নি।’
নতুন করে কমিটির একটি কাগজ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে, এই বিষয়ে তিনি বলেন, আমিও শুনেছি,তবে একটি কলেজে যে কেউ চাইলেই কমিটি দিতে পারেন না। সাংগঠনিক নিয়ম আছে। কেবল কেন্দ্রীয় সংসদই সেটা নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে মো. আবু তাহের (রিমন) ও কাজী মামুনুর রহমান (মাহিম)-কে সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। নেত্রী পর্যন্ত এই কমিটি সম্পর্কে অবগত। নেত্রী, গঠনতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কারো কোনো সিদ্ধান্ত দেবার সুযোগ নেই। আর যারা চায়ের দোকানে- রেস্টুরেন্টে বসে সকাল বিকাল কমিটি দেন, তাদের নিজেদেরই বৈধতা নেই। গঠনতন্ত্রের বিধান মোতাবেক একজন আইনজীবী কখনো আইন ছাত্র পরিষদের পদে থাকতে পারেন না। নাজিম- নোমান দুজনই আইন পেশায় জড়িত।
বর্ধিত সভার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজেদের মনগড়া নিয়মে কথিত বর্ধিত সভা করে এ সমস্ত ভুয়া কমিটি করেছে নাজিম- নোমান। সভা আহবান করার এখতিয়ার সাধারণ সম্পাদকের। তাছাড়া সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর ছাড়া কোন কমিটি অনুমোদন লাভ করতে পারেনা। নেত্রীর সিদ্ধান্তে সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন লায়েকুজ্জামান মোল্লা, যেহেতু তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন, পরবর্তী সম্মেলন পর্যন্ত রদ বদল করার এখতিয়ার তার।
জানা যায় তৎকালীন বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম টিটু স্বাক্ষরিত গত ২০১৮ সালে ‘সংগঠনের ২নং সহ-সভাপতি মো. নাজিম মিয়া সংগঠনের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকায় এবং সংগঠনের অপর ১নং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নোমান হোসেন তালুকদারকে সংগঠনের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ড সহ ড.কামাল হোসেনের জামাতা ডেবিড বার্গম্যানের সহকারী হিসাবে যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরবর্তী ২ বছর পর্যন্ত কাজ করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদেরকে বহিষ্কার করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা (মশিউর) বলেন, এখন যারা সকাল-বিকাল ভুয়া কমিটি দিচ্ছেন, তাদেরকে দলীয় শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা নিজেরাই অনেকগুলো দলে ভাগ হয়ে গেছে। শুনেছি তারা একে অন্যকে এখনও গালি-গালাজ করে।
জানতে চাইলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন মৃধা বলেন, রিমন-মাহিমকে কেন্দ্রীয়ভাবে সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এছাড়া বহিষ্কৃত নাজিম-নোমান তাদের মনগড়া কমিটিতে নিজেদের বৈধতার জন্য রিমনকে সভাপতি ও মাহিমকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটির তারা অবৈধ অনুমোদন দেয়, তাদের দেওয়া কমিটি কোনোভাবেই বৈধ নয়। এর পর তারা কয়েকমাস অন্তর অন্তর পরপর আরও দুটি কমিটি দেয়।
তিনি আরও বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে নাজিম-নোমানকে ২০১৮ সালেই বহিষ্কার করা হয় এবং কেন্দ্র থেকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এদের স্বাক্ষরিত সকল কার্যক্রম অবৈধ বলে জানানো হয়। অন্য দিকে সাবেক সভাপতি মো. শহীদুল ইসলাম টিটু উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে অবস্থান করায় এবং আইনজীবী হওয়ায় আইন ছাত্র পরিষদ থেকে অব্যাহতি দিলে সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী গঠনতন্ত্রের বিধান মোতাবেক ১নং সহ-সভাপতি মো. সেলিমুর রহমান (সেলিম) ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান। পরে তাকে পূর্ণ সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বছরে তিনবার কমিটি দেয়ার কারণে বিব্রত হতে হচ্ছে এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সবাই কমিটি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে। তারা একটি কমিটিতে রিমনকে সভাপতি করেন ও দুটি কমিটিতে মাহিমকে সাধারণ সম্পাদকে বহাল রাখেন, তাই বলে তাদের দেওয়া কামটিকে বৈধ বলা যায় না। রিমন-মাহিম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে নাজিম-নোমানের অবৈধ কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। চলতি কমিটিতে রিমনকে সভাপতি থাকা অবস্থায় তাকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেদের মনগড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে নিয়ে তার সভাপতি পদ খালি করে নতুন কমিটি দেয়। যা বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের ইতিহাসে নজিরবীহিন বলে উল্লেখ করেন মৃধা। নাজিম-নোমানের নিজেদেরই পদ নেই তারা যখন তখন, যার তার পদ শূন্য করে ফেলেন।
এ বিষয়ে সংগঠনের সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার বর্তমান সভাপতি ও বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের (সাধারণ সম্পাদক) জি.এস মো. আবু তাহের রিমনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। সংগঠনের সেন্ট্রাল ল’ কলেজ শাখার বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি কাজী মামুনুর রহমান মাহিমের ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী আমাদের কমিটি বহাল রয়েছে। এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা দেখছেন।
তাদের এই কমিটি বাণিজ্যের লাগাম এখনি টেনে ধরা উচিত বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মো. সফিকুল ইসলাম।
সংগঠনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের (ভারপ্রাপ্ত) সাধারণ সম্পাদক ও শাহবাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. রিয়াজ উদ্দিন খান (রিয়াজ) বলেন, এটা আইনজীবীদের সংগঠন নয় এটা আইনের ছাত্রদের সংগঠন। এখানে কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ সহ্য করা হবে না।
কাউকে না জানিয়ে কমিটিতে নাম দেয়ার অভিযোগ রয়েছে নোমান-নাজিমের বিরুদ্ধে। সেন্ট্রাল ল’ কলেজ বঙ্গবন্ধু আইন ছাত্র পরিষদের সাবিহা আক্তার (মিলি) নামের এক নেত্রী নিজের নাম নাজিম-নোমানের দেওয়া অবৈধ কমিটিতে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন।’ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহারেরও দাবি করেছেন তিনি।
এদিকে নিজেদের কর্মী সমর্থক দেখানোর জন্য বিএনপি-জামাত-শিবির অনুপ্রবেশকারীদের দিয়েও কমিটি দেওয়ার সত্যতা মিলেছে নাজিম-নোমানের বিরুদ্ধে।