২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলংকিত রাত। মানুষ রূপী দানবের তান্ডপ কতটা নির্মম ও ভয়াবহ হতে পারে তার প্রমান দিয়েছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ঘুৃমন্ত বাঙালির ওপর হত্যাকান্ড চালিয়ে। জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় এই কালরাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে পাকিস্তানের জলপাই রং এর দানবরা এক রাতে ১ লাখেরও বেশি নিরীহ বাঙালির ওপর পৈশাচিক হত্যাকান্ড চালায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘটানো হত্যাকাণ্ডের দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব পাস হয়।
ইতিহাসবিদ, দেশি-বিদেশি জার্নাল ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা গ্রন্থে ২৫ মার্চের যে লোমহর্ষক তথ্য পাওয়া তা সঠিকভাবে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা গেলে আর যাই তারা কেউ অন্তত পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না, যদি না তার উত্তরসূরী স্বাধীনতা বিরোধী না হয়। কি ঘটেছিল সর্বনাশা সেই রাতে : ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়কে সামনে নিয়ে আসতে হবে মুক্তি যুদ্ধের চেতনাকে আরো গতিশীল করার স্বার্থে। সেদিন বিকাল ৫টা বেজে ৪৪। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে বিমানে করে করাচি পালালেন। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই দিয়ে সৈন্য, ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মার্কিন ট্যাঙ্ক। সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল (জহুরুল হক) হলের প্রতিটি রুমে ঢুকে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক নরপিশাচের দল।। ইতিহাসের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডে একে একে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হলের ১০৩ জন হিন্দু ছাত্রকে। এমনকি হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাক জান্তাদের নৃশংসতার কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় এই কাল রাতে।
নির্বিচারে গণহত্যায় বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে সেই আশংকায় পাক জল্লাদরা সেই রাতে হামলা চালায় রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তরে । পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রুর ট্যাঙ্ক আর ভারি মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত ব্যারিকেড। নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাক হানাদারদের নির্বিচারে গুলি বর্ষণে মধ্যরাতে ঘুমন্ত নগরী মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২৫ মার্চ মধ্য রাতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।
স্বাধীনাতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন- ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষবার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়-২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটি তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে ও বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় পাক হানাদার বাহিনীর। অতঃপর গণহত্যা চালিয়েও বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখাতে পারেনি বর্বর পাক বাহিনী । কোন গণহত্যায় কত জন নিহত হয়েছেন তার নির্ভুল হিসাব আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। গণহত্যার তীব্রতা, স্থায়িত্ব, জনসংখ্যা সব মিলিয়ে গণহত্যায় নিহতদের আনুমানিক হিসাব করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপজুড়ে নাজি, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যালানজিস্টরা যে গণহত্যা চালায় তার সময়সীমা ছিল চার বছরের বেশি। এলাকার ব্যাপকতা ছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ আয়তনে ছিল ছোট, কিন্তু জনঘনত্ব ছিল বেশি। সে কারণে এখানে অল্প সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকাররা বেশি মানুষকে হত্যা করার সুযোগ পায়। এক চুকনগরে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে, এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কোথাও আর হত্যা করা হয়নি।
গণহত্যার হিসাব নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা”র প্রকাশিত তথ্য মতে , গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ। অনেকেের মতে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন- ‘৩০ লাখ হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খাবে’- প্রাভদা কর্তৃপক্ষ হয়তো সেটি মনে রেখেছিল এবং সে আলোকেই ঘোষণা করেছিল ৩০ লাখ নিহত হয়েছিল।
সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপ নামে একটি জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে ছিল জাতিসংঘ। এই জরিপের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এ হার গণহত্যার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
গণহত্যার যে হিসাব ১৯৭১ সালে দেওয়া হয়েছিল সেখানে ধরা হয়নি উদ্বাস্তু শিবিরে মৃত্যুর সংখ্যা। শিবিরের কর্তৃপক্ষও দিতে পারেনি। কিন্তু তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কিত বীভৎস রিপোর্ট ও ছবি ছাপা হয়েছে।
গণহত্যার একটি লোমহর্ষক ছবিতে দেখা গেছে একটি মরদেহ কুকুরে খুবলে খাচ্ছে। আমেরিকার লাইফ পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শকুনরা অতিমাত্রায় মরদেহ খাওয়ায় তাদের অরুচি ধরে যায়। এই মরদেহের সংখ্যা অবশ্যই গণহত্যার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ২ লাখের বেশি নারী অমানবিক ধর্ষণ ও নিগ্রহের শিকার হয়। অগণিত বাঙালি নারীকে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে হায়েনার দল। অধিকাংশ তরুণীকে রাতের আধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়েছিল। আমেরিকার নারীবাদী লেখক ও সাংবাদিক সুসান ব্রাউন মিলার তার এক নিবন্ধে জানান, চার লাখের বেশি নারী ওই সময় নির্যাতনের শিকার হন লোভাতুর পাকসেনাদের হাতে।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি নরপিশাচ হায়েনারা যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছে, গণহত্যা ঘটিয়েছে যে তা পৃথিবীর যেকোনো বর্বরতাকে হার মানায়। একদিকে যেমন সামরিক বাহিনী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বেসামরিক রাজাকার-আলবদর-আল শামস্ বাহিনীও গ্রামগঞ্জে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। হত্যার আগে লুটপাট ছিল নিত্য দিনের ঘটনা।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি এই গণহত্যার দায়ে কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। মুক্তিযু্দ্ধের ইতিহাসকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে ও বাংলার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করে এই অপশক্তি ।
দীর্ঘ ২১ বছর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যেগ নিয়ে বিচারহীনতা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যেগ নেন। দেশি বিদেশি পরাশক্তির ষড়যন্ত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্বেও ক্ষমতায় আসতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। আবার টানা ৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ২০০৮ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব আসে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে। টানা চতুর্থ মেয়াদে দেশ পরিচালনাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ অসংখ্য মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য এখন সবার মুখে মুখে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও গণমানুষের দল হওয়ায় আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাঙালির প্রত্যাশা সব সময়ই একটু বেশি। স্বাধীনতা ৫৩ বছর পর জোরালো দাবি উঠেছে ২৫ মার্চের গনহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের।
ইতিমধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থাগুলো হলো; লেমকিন ইনস্টিটিউট, জেনোসাইড ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর সাইটস অব কনসিয়েন্স। কিন্তু জাতিসংঘ একে আজও স্বীকৃতি দেয়নি। এই স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। এ নিধনযজ্ঞের সাথে জড়িতদের বিচার করতে হবে। স্বীকৃতি আদায়ে জনমত তৈরিতে ব্যাপক লেখালেখি, কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১সালের ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গনহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। প্রধানমন্ত্রীর এই আহবানকে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে নিয়ে আমরা আশাবাদী গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিষয়ে।
মনে রাখতে হবে, একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় দোসররা এখনো এদেশের মাটিতে সক্রিয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ও আদর্শকে ধূলিসাৎ করতে তাদের নানামুখি ছকের শেষ নেই । জেনোসাইডের বিচার না হলে শহীদদের রক্ত-ঋণ যেমন শোধ হবে না, তেমনি পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় দোসরদেরও প্রতিহত করা যাবে না।
তাই আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে ২৫ মার্চের গনহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী ও তাদের দোষরদের প্রতি ঘৃণা জাগাতে৷ গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে বারবার।
লেখক : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহ সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য।