স্বর্ণ এখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদানে পরিণত হয়েছে। একসময় মুদ্রার বিনিময়হার নির্ণয়ে স্বর্ণমান ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম, যা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বর্ণমান বিলুপ্ত হলেও স্বর্ণ আর্থিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংক, ফাইন্যান্স বা অর্থনীতির বিষয় বাদ দিয়ে স্বর্ণের বাজারমূল্য নিয়ে আমার লেখার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্বর্ণ এখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদানে পরিণত হয়েছে। একসময় মুদ্রার বিনিময়হার নির্ণয়ে স্বর্ণমান ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম, যা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্বর্ণমান বিলুপ্ত হলেও স্বর্ণ আর্থিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আর এ কারণেই বিশে^র অনেক বৃহৎ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সোনালি ধাতুতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে থাকে। বর্তমান বিশে^ কমোডিটি ট্রেডিং এক বিশাল মার্কেট, যেখানে ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে লেনদেন হয় এবং স্বর্ণ এই কমোডিটি ট্রেডিং মার্কেটে ভালো একটি জায়গা দখল করে আছে। বিশ^ব্যাপী এক বিশাল মার্কেট হওয়ার কারণে বিশে^র বড় বড় সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কমোডিটি ট্রেডিং মার্কেটে ব্যাপক অংশগ্রহণ করে থাকে। এই উদ্দেশ্যে তাদের আছে বৃহৎ একটি বিভাগ, যেখানে অসংখ্য মেধাবী পেশাদার ব্যাংকার দায়িত্ব পালন করে।
এ কারণেই বর্তমান আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত থাকলে স্বর্ণের দামের গতি-প্রকৃতির দিকে মনোযোগ থাকবেই। শুধু স্বর্ণ নয়, অন্য যেকোনো মূল্যবান ধাতু বা কমোডিটির বাজার মূল্যের ওঠানামা ব্যাংকার এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। অন্যান্য ধাতু বা কমোডিটির তুলনায় স্বর্ণের মূল্য বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা।
স্বর্ণ সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু এ কথা সবারই কমবেশি জানা। যদিও স্বর্ণই পৃথিবীতে একমাত্র মূল্যবান ধাতু নয় বা স্বর্ণই যে সবচেয়ে বেশি মূল্যের ধাতু, তেমন নয়। পৃথিবীতে আরও কিছু ধাতু বা খনিজ পদার্থ আছে যা স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। কিন্তু সাধারণ মানুষের ব্যবহারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় স্বর্ণ হচ্ছে সবার পরিচিত এক অতি মূল্যবান ধাতু। মূল্যবান ধাতু হওয়ার কারণেই সব সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে স্বর্ণের কদর সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে স্বর্ণ ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা চিন্তাই করা যায় না। স্বর্ণের এমন ব্যাপক চাহিদার কারণ যে শুধু মূল্যবান ধাতু, তেমন নয়। স্বর্ণের ক্ষয় নেই কথাটা যেমন সত্য, তেমনি স্বর্ণের মূল্যের কমতি নেই কথাটাও সমানভাবে সত্য।
আর এই সত্যের কারণেই স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলে। আমার নিজের বিয়ের সময় প্রতি ভরি স্বর্ণ কিনেছিলাম প্রায় ১০ হাজার টাকা মূল্যে, যা আমার মেয়ের বিয়ের সময় হয়তো কিনতে হবে প্রতি ভরি দেড় লাখ টাকা দিয়ে। উল্লেখ্য, স্বর্ণের পরিমাপের একক যে ভরি, তা মূলত আমাদের দেশেই প্রচলিত। ভরি স্বর্ণ পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো একক কি না আমার জানা নেই। স্বর্ণ পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একক হচ্ছে গ্রাম বা ট্রয় আউন্স।
স্বর্ণ চিরদিনই অতিমূল্যের এবং ক্রমাগত বর্ধিত মূল্যের ধাতু হলেও বিগত কয়েক বছরে এই সোনালি ধাতুর মূল্য যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে তা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনীতিবিদ, আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ এবং কমোডিটি ট্রেডিং মার্কেটের বিশ্লেষক; সবাই স্বর্ণের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি দেখে হতবাক। গত দুই বছরে স্বর্ণের যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে তা আগের দশ বছরেও হয়নি। কেননা গত দুই বছরে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ বা তার বেশি।
এমনকি গত চার মাসেও বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে স্বর্ণের দামে। গত মে মাসে যেখানে এক ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ২ হাজার ৪০০ ডলার, তা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮২ ডলার। অর্থাৎ মাত্র চার মাসের ব্যবধানে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ট্রয় আউন্স প্রতি ২৮২ ডলার।
বিগত কয়েক বছরে স্বর্ণের এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যে শুধু বাজারের চাহিদা এবং জোগানের বিষয় জড়িত তেমন নয়। বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং কমোডিটি ট্রেডিং মার্কেটে অতি বিনিয়োগের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক উপাদান। বিশ্বে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রা ডলার, ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনকে শত্রুভাবাপন্ন বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, যাকে অনেক বিশ্লেষকই স্বর্ণের আকাশচুম্বী উচ্চমূল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন। ২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা রাশিয়ার ওপর কঠোর স্যাংশন আরোপ করে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ রাশিয়ার গচ্ছিত ডলার হিসাব জব্দ করে। এমনকি রাশিয়াকে বিশে^র ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে তাদের কয়েকটি ব্যাংককে সুইফট থেকেও বহিষ্কার করে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে যেসব দেশ ডলারে লেনদেন করবে তাদের বিরুদ্ধেও স্যাংশন আরোপ করা হবে মর্মে সতর্ক করা হয়।
এভাবে ডলার এবং আমেরিকার আর্থিক ব্যবস্থাকে নির্বিচারে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে অনেক দেশই ডলারে অর্থ জমা রাখার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পরে এবং বিকল্প ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করতে থাকে। এই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণ মজুদ করতে শুরু করে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের উদ্বৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে বিশ্বের অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিশেষ করে এমারজিং মার্কেটের (চীন-ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ) কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২ হাজার ২০০ টন স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি করেছে গত ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে যা মূলত স্বর্ণের বাজারে ১৭০ বিলিয়ন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এ কথা ঠিক যে বিশে^র সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ ক্রয়ের বিষয়টি কখনোই সেভাবে প্রকাশিত হয় না, ফলে এর সঠিক তথ্য জানাও সম্ভব হয় না। তথাপি যতটুকু আলোচনা আন্তর্জাতিক মাধ্যমে হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের ছয়টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, বিশেষ করে ভারত, চীন এবং তুরস্ক ব্যাপক হারে স্বর্ণ মজুদ বৃদ্ধি করেছে।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত একটানা ১৮ মাস ধরে স্বর্ণ ক্রয় করেছে। ফলে চীনের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ, যা প্রায় দশ মিলিয়ন ট্রয় আউন্সের সমপরিমাণ। চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। এ কথা ঠিক যে এই বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কখনোই সম্পূর্ণরূপে স্বর্ণ বা অন্য কোনো মূল্যবান ধাতুতে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এটিও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে চীনের বিশাল এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সামান্যতম অংশও যদি স্বর্ণের স্থানান্তর করা হয় তা হলেই স্বর্ণের বাজারে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হবে এবং স্বর্ণের দামও তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকবে। যেমন, গত এপ্রিলে চীনের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ, যা আজ থেকে দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। শুধু চীন একা নয়, ভারতসহ আরও অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণ মজুদ করে সংরক্ষণ করছে।
অতি মূল্যবান এই সোনালি ধাতুর ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং এর অতি মূল্যের প্রবণতার সঙ্গে যখন রাজনৈতিক কারণ যোগ হয়, তখন এই ধাতুর মূল্য আকাশচুম্বী হবে এটিই স্বাভাবিক। বর্তমানে স্বর্ণের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এবং আগামীতে বিশে^র রাজনৈতিক অবস্থা যে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার দিকে চলে যেতে শুরু করেছে, তাতে স্বর্ণের মূল্য যে নিম্নমুখী হবে তেমন সম্ভাবনা খুবই কম। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশে^র অনেক বৃহৎ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদনে স্বর্ণ মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যে আগামীতেও অব্যাহত থাকবে তেমন ধারণাই দিয়ে আসছে। সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ ব্যাংক, ইউবিএসের এক প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে যে আগামী বছরের শেষ নাগাদ প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম হবে ২ হাজার ৮০০ ডলার। আমেরিকাভিত্তিক বিশ্বের আরেক বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের এক প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে যে এই একই সময় প্রতি ট্রয় আউন্স স্বর্ণের দাম হবে ৩ হাজার ডলার।
সবকিছু বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে বিগত কয়েক বছর ধরে স্বর্ণ মূল্যে যে আকাশচুম্বী প্রবণতা, তার পেছনে যেমন চাহিদা-জোগান এবং বিনিয়োগের বিষয় আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক কারণ। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে আমেরিকার স্যাংশন ভীতি কাজ করছে এবং ডলারের ঝুঁকি লাঘবের যে কৌশল গ্রহণের চেষ্টা চলছে, তাই মূলত স্বর্ণের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
স্বর্ণের দামে খুব সহসা যে ভাটা পড়বে তেমন লক্ষণ আপাতত নেই বললেই চলে। উল্টো এই মূল্যবৃদ্ধির ধারা যে আগামীতেও অব্যাহত থাকবে তেমন সম্ভাবনাই খুব বেশি। স্বর্ণ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। খুব সহসাই এই সোনালি ধাতু হয়তো উচ্চবিত্তের নাগালের বাইরেও চলে যাবে। এমনকি অনেক দেশেরও নাগালের বাইরে চলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক :
নিরঞ্জন রায়
অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকার।