তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন চেয়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপি ছয় মাস লাগাতার আন্দোলন করলেও বড় কোনো অঘটন ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। ভোটের আগে নানা কথা বললেও একে একে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এখন স্থানীয় সরকারের ভোটে নজর দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সবার আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে মাঠে সরব আওয়ামী লীগ আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিএনপি।
বিএনপির শীর্ষনেতারা বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বললেও নিজ এলাকায় অস্তিত্ব ধরে রাখা এবং কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখার জন্য স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ভাবছে দলটির তৃণমূল নেতারা।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এ নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন হবে। একই দিনে কয়েকটি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল ঘোষণা করা হবে।
ইতোমধ্যে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনগুলো আর দলীয়ভাবে হবে না বলে সরকার থেকে জানানো হয়েছে। যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতারা ভোট করতে পারবেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। গণভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মতামত ব্যক্ত করেন।
এদিকে দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতারা নির্বাচন অংশ নেওয়ার কথা বললেও দলটির হাইকমান্ড বলছে, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অচিরেই স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বললেও দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হয় সেক্ষেত্রে আমরা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবো।
দলটির একটি সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও এবার দলের কেউ স্বতন্ত্রভাবে ভোট করতে চাইলে বাধা দেওয়া নাও হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে নয়াকন্ঠের কাছে দলের কোনো নেতা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন শুরু হয়। দলটি ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। বরং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তৃণমূলের অনেক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এর মধ্যে ২০২২ সালে বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও মনিরুল হক সাক্কু নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
বিএনপির স্থানীয় নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। এর মাধ্যমে বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। সুতরাং নির্বাচনে যাওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তারা বলছেন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়া নেতাকর্মী এলাকামুখী হতে পারবেন। তাছাড়া এ নির্বাচনেও যদি সরকার কারচুপির আশ্রয় নেয়, সেক্ষেত্রে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আরো একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়ে ১৮ বছর জনপ্রতিনিধি ছিলেন খুলনা বিভাগের এমন একজন নেতা বলেন, বিএনপির উচিত আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে না গেলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও ধরে রাখা কঠিন। স্থানীয় নির্বাচনে অনেকের আত্মীয়স্বজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় সামাজিকতার কারণে পারস্পরিকভাবে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হন।
এ বিষয়ে বৃহত্তর খুলনার এক জেলা সভাপতি বলেন, স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন ভিন্ন প্রেক্ষাপট। স্থানীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন। এ নির্বাচন নির্ভর করে স্থানীয় ভিতের ওপর। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মীরা সরব হবে। আর যেহেতু এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকবে না, তাই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি সারোয়ার জাহান চৌধুরী বলেন, বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে আমার মনে হয় না। এ নির্বাচনে যাওয়া মানে অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়া। মামলা-জুলুমের শিকার হওয়া। এ সরকারকে বিদায় না করা পর্যন্ত কোনো অবাধ নির্বাচন এদেশে সম্ভব নয়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের এক জেলার সদস্য সচিব বলেন, নির্বাচন নিয়ে বরাবরই নেতাকর্মীদের একটি আগ্রহ থাকে। আর প্রতীক না থাকলে আগ্রহটা বাড়বে। যেহেতু জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এ নির্বাচনের পার্থক্য আছে। তাই উপজেলা নির্বাচনে গেলে বিএনপির জন্য, বিশেষ করে তৃণমূলে যারা আছেন তাদের মধ্যে সতেজতা বৃদ্ধি পাবে।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা না থাকলে বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিইনি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে উপজেলা নির্বাচনে যদি দলীয় প্রতীক বাধ্যতামূলক না থাকে সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা নীতিনির্ধারণী ফোরামসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বিএনপির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। আলোচনা হলে ফাইনাল জানাবো। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে আমি নারাজ।’
‘ভোটের আগে বিএনপি নানা কথা বললেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন সরকারকে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা একে একে অভিনন্দন জানাচ্ছে’ এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে প্রসঙ্গ এড়িয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে সকল নির্বাচন জনগণ বর্জন করেছে। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, প্রতিবাদস্বরূপ মানুষ স্থানীয় নির্বাচনেও ভোটকেন্দ্রে যাবে না।’