অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন হাসেম বোরহান উদ্দিন (৪০)। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই নিজেকে ভোলায় দরবেশ পরিচয় দেন। নিজেকে জাহির করতে রপ্ত করেন আরবি, হিন্দি ভাষা। হিপনোটাইজ করার মতো সব দক্ষতাই আছে হাসেমের। ২০১৬ সাল থেকে নিজেকে পুরোপুরি দরবেশ পরিচয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন।
কাউকে চাকরি দেওয়া, লটারি জেতানো, কারো স্বামীকে বশে এনে দেওয়া, বাচ্চা না হওয়া নারীকে সন্তান ধারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত ১৮ বছরে অন্তত ৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়েছেন তিনি। এ টাকায় গ্রামে করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট ও গাড়িও।
সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি নার্সকে স্বামী বশে আনার কথা বলে এক বছরে সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ভণ্ড দরবেশ হাসেমের প্রতারণার বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) নজরে আসে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্তের ভিত্তিতে প্রথমে গতকাল শনিবার ভণ্ড দরবেশের সহকারী তানজিলকে (৩০) উত্তরা থেকে ও পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসেমকে।
স্বামীকে বশে আনতে দরবেশ হাসেমকে এক নার্স দেন সাত কোটি টাকা
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, আনোয়ারা বেগম (৫৯) একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার তিন ছেলে-মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা দেশের বাইরে থাকেন। স্বামী নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায় ও ভুগছিলেন। স্বামীকে বশে আনার পথ খুঁজছিলেন তিনি।
একদিন ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপনে দেখেন, সুন্দর-সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধান করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুজন মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখায়; যেখানে মেয়ে দুটিকে বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশ বাবার কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।
এটা দেখে আনোয়ারা বেগম তার বাসার কাজের মেয়ের সাথে বিষয়টি আলোচনা করেন। তারপর যোগাযোগ করেন ও পারিবারিক সমস্যার কথা দরবেশ বাবার সঙ্গে আলোচনা করেন।
দরবেশ বাবা তার সমস্যার কথা শুনে তাকে বলেন, ‘মা তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখো। আমি তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যা সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরও বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।’
সুন্দর ব্যবহার ও কথা বলে দরবেশ বাবা তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অ্যামাউন্টের টাকা বিকাশ করতে বলে। ভক্ত আনোয়ারা বেগম দরবেশ বাবার কথা মতো বিকাশে টাকা পাঠান। এভাবে বিভিন্ন সময়ে দরবেশ বাবা আনোয়ারা বেগমকে ফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে থানায় জিডি
একসময় ভক্ত আনোয়ারার মোহ ভাঙে। বুঝতে পারেন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। প্রতিকার পেতে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। করেন সিআইডি’তেও অভিযোগ। সিআইডি প্রধানের নির্দেশে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভুক্তভোগী আনোয়ারার অভিযোগের সত্যতা পায়, শনাক্ত হয় কথিত দরবেশও।
দরবেশ মনে করে প্রথমে সহকারী তানজিলকে গ্রেপ্তার
অবস্থান শনাক্তের পর ঢাকার উত্তরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে প্রথমে অভিযুক্ত তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে জানা যায় তিনি আসল দরবেশ নয়। তার বয়ানেই প্রথম উঠে আসে আসল দরবেশের ভণ্ডামি। তানজিল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চক্রের মূলহোতা হাসেম বোরহান উদ্দিন।
দরবেশ হাসেম নয়, তানজিলকে চিনতো ভুক্তভোগী আনোয়ারা
হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অ্যামাউন্টের টাকা নিতেন। বড় অঙ্কের টাকা নিতে তানজিলকে আনোয়ারা বেগমের কাছে পাঠাতেন হাসেম। তানজিল আহমেদ এক সঙ্গে ৩০- ৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেতেন। এভাবে ধাপে ধাপে তারা আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ নয়াকণ্ঠ’কে বলেন, অভিযুক্ত তানজিল আহমেদ জানান, চক্রের মূল হোতা হাসেম বোরহন উদ্দিন ভোলায় অবস্থান করছেন। পরে সিআইডির একটি টিম ভোলায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করে।
১৮ বছর ধরে প্রতারণা, প্রচারণায় খচর মাসে চার লাখ
বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ২০০৫ সাল থেকে দরবেশ সেজে প্রতারণা করে আসছিল হাসেম। প্রথম দিকে দরবেশ হিসেবে নিজের এলাকায় পরিচিতি পান। পরিচিতি বাড়াতে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতেন। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকেও বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেন। প্রতিমাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতেন এবং পোস্ট বুস্ট করতেন। যাতে তার বিজ্ঞাপন সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
মধ্যপ্রাচ্যসহ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাঙালিরা হাসেমের টার্গেট
সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কর্মরত স্বল্প-শিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করেছিলেন হসেম। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এছাড়াও তিনি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন। এভাবে তিনি পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সাথে দরবেশ বাবা পরিচয় দিয়ে কথা বলতেন ও তাদের কাছ থেকে ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেন।
নিজেকে দরবেশ বাবা জাহির করতে নানা হিন্দি-আরবি রপ্ত
দরবেশ বাবা হিসেবে নিজেকে জাহির করতে প্রতারক হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলতেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন রকম কণ্ঠে কথা বলতে পারেন, যেমন জ্বীন-পরীর কণ্ঠ, ২০০ বছরের হুজুরের কণ্ঠ, ১০০ বছরের বাবার কণ্ঠ।
জিজ্ঞাসাবাদকালে ফোন করে টাকা পাঠাতে চান ফ্রান্স প্রবাসী
রেজাউল মাসুদ বলেন, নানা উপায়েও হাসেমের মুখ থেকে কথাই বের করা যাচ্ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদকালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফোন করেন ইমাম নামে একজন। তিনি টাকা পাঠাতে চান। তখন আমরা তার সঙ্গে আলাদা করে যোগ করে জানতে পারি তিনি লটারি জেতার জন্য চার বছরে দেড় কোটি টাকা দিয়েছেন।
ইমাম হোসেন (৪০) সিআইডিকে জানান, ফেসবুক সূত্রে দরবেশ বাবার সঙ্গে পরিচয় তার। ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চর বছরে দেড় কোটি টাকা দিয়েছেন তিনি।
রেজাউল মাসুদ বলেন, একই সূত্রে আমরা আরেক ইতালি প্রবাসীর সন্ধান পাই। যিনি নিজেও লটারি ও জুয়ায় টাকা জেতার জন্য প্রায় ৪০ লাখ তুলে পাঠিয়েছেন দরবেশ হাসেমের দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।
ফ্রান্স প্রবাসী ইমামের পরিবার না খেয়ে, দরবেশ বাবা বাড়ি-গড়ির মালিক
বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, আমরা সিআইডি টিম পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ফ্রান্স প্রবাসী সেই ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেন। প্রবাসীর বউ-বাচ্চা খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছেন। অথচ প্রবাসে তার কষ্টে উপার্জন করা টাকায় ভণ্ড দরবেশ বাবা বাড়ি-গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। প্রবাসী ইমাম হোসেন একপর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলে। বড় বোন তার ছেলের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় দরবেশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছেন।
ভোলায় গড়েছেন বাড়ি, ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট-গাড়ি
অষ্টম শ্রেণিতে পাস করা হাসেম প্রতারণার টাকায় নিজ গ্রামে গড়েছেন বাড়ি, রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রীর নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট। এছাড়া কিনেছেন গাড়ি। নামে বেনামে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও বিপুল পরিমাণ টাকার কথা জানা গেছে। ব্যাংকে তার লেনদেন ও টাকার পরিমাণ জানার চেষ্টা চলছে।
প্রতারণার টাকার ৬০ ভাগ পেতেন হাসেম, তানজিল ৪০ ভাগ
প্রতারণার টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হতো নিজেদের মধ্যেই। প্রতারণার মাধ্যমে গত ১৮ বছরে তিনি অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। এর মধ্যে হাসেম নিয়েছেন ৬০ ভাগ, তানজিল ৪০ ভাগ। তাদের কর্মচারী রয়েছে ৬ জন। উত্তরায় ভাড়া নেওয়া অফিসের লাখ টাকার খরচ ও কর্মচারীদের বেতন হতো প্রতারণার টাকাতেই।
সিআইডির অনুসন্ধানের বরাতে রেজাউল মাসুদ নয়াকণ্ঠ’কে জানান, মধ্যপ্রাচ্যে হাসেম চক্রের ২০/২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়াতে আছে ১০/১২ জন। এর মধ্যে ৫/৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছে। যারা গত ৪/৫ বছর ধরে এ প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছে। দুজনকে ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের আগামীকাল আদালতে সোপর্দ করা হবে।