হোসাইন আহমদ ওরফে ডাকাত হোসাইন ওরফে মানব পাচারকারী হোসাইন ১৯৯০ সালেও টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের উনছিপ্রাং এলাকার শীর্ষ ডাকাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উনছিপ্রাংয়ের মৃত আবদুল আলিমের ছেলে হোসাইন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পুলিশের তালিকায় তিনি মানব পাচারকারীদের মধ্যে অন্যতম। একাধিক মামলা থাকলেও এলাকায় বীরদর্পে ঘুরে বেড়ান তিনি। গত ২৪ এপ্রিল মিয়ানমার থেকে প্রায় আড়াই বছর কারাভোগের পর বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রচেষ্টায় দেশে ফেরত আসেন ১৭৩ জন। তাদের অনেকেই হোসাইনের মানব পাচারের শিকার।
মালয়েশিয়া থেকে ফেরা নোমান নামের এক তরুণ বলেন, হোসাইন দালালের মাধ্যমে আমরা ৫০ জন মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে টেকনাফ হয়ে সাগরপথে প্রথমে থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য ট্রলারে উঠি। সীমানা অতিক্রম করার পরই সাগর থেকে বিজিপি (মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর) সদস্যরা আমাদের আটক করে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে উনছিপ্রাং এলাকার শীর্ষ ডাকাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন হোসাইন। করতেন চিংড়ি ঘেরে ডাকাতি। পরে উনছিপ্রাং এলাকার মানুষের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানে মালয়েশিয়ান এক নাগরিককে বিয়ে করেন। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় হোসাইন আহমেদের। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় এক কন্যা রয়েছে তার। কন্যার বয়স ২২ বছর। এই সূত্রে হোসাইন মালেশিয়ায় নাগরিকত্ব পান। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর ২০০৭ সালে উন্নত জীবনের আশা দেখিয়ে আকাশপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার মৃত কামাল উদ্দিনের ছেলে এহসান ও উনছিপ্রাং এলাকার আজিজুর রহমানের ছেলে আনোয়ারসহ ৭ জনকে ট্যুরিস্ট ভিসায় সিঙ্গাপুর নিয়ে নামিয়ে দেন। পরে সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে আটক হয়ে তারা দেশে ফেরেন। এরপর হোসাইনের কাছে তারা টাকা ফেরত চাইলে তিনি টাকাও ফেরত দেননি।
ওই সূত্র জানায়, হোসাইন আহমেদ মানব পাচারে আকাশপথে ব্যর্থ হলে ২০১৫ সালে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাচার শুরু করেন। তার প্রথম যাত্রায় ছিলেন ২০ জন। তারা উনছিপ্রাং এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী, একই এলাকার সৈয়দ করিম এবং ছৈয়দ আলমসহ ২০ জন। তারা ২০ দিনের মধ্যে মালয়েশিয়া পৌঁছান। এতে ভাগ্য খুলে যায় হোসাইন দালালের। তার পর থেকেই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রচার বেড়ে যায়। এরপর থেকে উনছিপ্রাং, হোয়াইক্ষং, হ্নীলা, সাবারাং ও বাহারছড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়া শুরু করে মানুষ। সেখান থেকেই কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় হোসাইনের।
মানব পাচার করে কোটিপতির স্বাদ নেওয়া হোসাইন পরের বছরই হোঁচট খান। ২০১৬ সালে টেকনাফ উপকূল এলাকায় হোসাইন দালালসহ তিন দালালের একটি বোটডুবির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় উনছিপ্রাং কালা মিয়ার ছেলে কালামসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। ওই মৃত্যুর ঘটনায় দেশে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের বিষয়টি সামনে আসে।
একই বছরের শেষের দিকে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সবজিবাহী একটি কার্ভার্ডভ্যান থেকে ৪০ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। ওই কাভার্ডভ্যান থেকে ৪ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর মালয়েশিয়া সরকার নড়েচড়ে বসে। মালয়েশিয়া সরকার এই ঘটনার তদন্ত শুরু করলে হোসাইন দালালের নাম উঠে আসে। মালয়েশিয়ার সরকার তার বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে। পরে হোসাইন স্ত্রী-কন্যাকে মালয়েশিয়া রেখেই থাইল্যান্ড চলে যান। থাইল্যান্ডেও তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি হলে গোপনে চলে আসেন বাংলাদেশে।
পরে হোসাইন দালাল দেশে ফিরে প্রথমে কোটি টাকা মূল্যের উনছিপ্রাং এলাকার নুরুল আমিন কোম্পানির মার্কেটের সামনে রাজকীয় বাড়ি নির্মাণ করেন। তার বয়স ৬০ হলেও পরে বিয়ে করেন ২০ বছর বয়সিী হ্নীলা এলাকার এক তরুণীকে।
দেশে যখন মানব পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় তখন তার নাম উঠে আসে এবং একের পর এক মামলা হয় হোসাইনের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে ঝিমংখালীতে একটি বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন হোসাইন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উনছিপ্রাং এলাকার ৯ তরুণকে আকাশপথে মালেশিয়া নেওয়ার কথা বলে সিঙ্গাপুরে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিন স্থানীয় সূত্র জানায়, রইক্ষং, লম্বাবিল এবং ঘোনাপাড়া এলাকায় কোটি কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন হোসাইন। সিঙ্গাপুরেও তার সিন্ডিকেট রয়েছে। মানব পাচার করার জন্য রয়েছে ১টি জাহাজ। জাহাজটি বর্তমানে থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মাঝামাঝি একটি দ্বীপে আছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
স্থানীয় সূত্র আরও জানান, ২০১৯ সালে মানব পাচারের অভিযোগে পুলিশ হোসাইন আহমদকে না পেয়ে তার ভাই সৈয়দ আকবরকে আটক করে। আকবরের বিরুদ্ধে ৪টি মানব পাচারের মামলা রয়েছে।
টেকনাফ সদরের রাজারছড়া এলাকার মোস্তাক আহমেদের ছেলে নোমান জানান, তিনিসহ ৫০ জন সমুদ্রপথে ট্রলার করে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে আটক হন তিনি। ওই ট্রলারে দেশের বিভিন্ন স্থানের আর ৪৯ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের বহনকারী ট্রলারটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। চার থেকে পাঁচ দিন সাগরে ভাসমান থাকার পর মিয়ানমারের নৌবাহিনী ও বিজিপি তাদের আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।
নোমান বলেন, হোসাইন দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রলোভনে পড়ে রামু ও মহেশখালীসহ আর বিভিন্ন এলাকার ৪৯ জন যাত্রী ছিলেন ট্রলারে।
একইভাবে নোমানের মতো হোসাইন দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েন হোয়াইক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহমদ। গত ২৪ এপ্রিল তিনি কক্সবাজারে বিআইডাব্লিউটিএ ঘাটে দুই ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এ সময় তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে মুক্তার আহমেদ ও আল মামুনকে অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে হোসাইন দালাল টেকনাফ বাহারছড়া জাহাজপুরা এলাকা থেকে বোটে তোলেন। বোটে কয়েক দিন থাকার পর তাদের মিয়ানমার সীমান্তে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি তাদের আটক করে। হোসাইন দালাল তাদের মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ২ লাখ টাকা নেন। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দালাল বিভিন্ন অজুহাত দেখাত। পরে দুই ছেলে মিয়ানমার থেকে কল করে জানায়, তারা কারাগারে আছে।
রশিদ আহমদ বলেন, ছেলেদের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাদের আবার ফিরে পাব, তা কল্পনাই করিনি। হোসাইন দালালের ঘরে বেশ কয়েকবার গেলেও উল্টো আমাকে হুমকি দিয়ে বের করে দিয়েছেন। তিনি অনেক প্রভাবশালী।
১৭৩ জনের বেশির ভাগই মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মিয়ানমারে আটক হন। ১৭৩ জনের মধ্যে ১২৯ জনই কক্সবাজার জেলার। ফেরত আসা বাংলাদেশি বেশির ভাগ নাগরিকই তাদের এ সীমাহীন দুর্ভোগ আর বিপজ্জনক পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বারবার টেকনাফ হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং এলাকার হোসাইন দালালের নাম বলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ এপ্রিল ১৭৩ জন মিয়ানমারে কারাভোগের পর দেশে ফিরেছেন। মানব পাচারের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
হোসাইন দালালের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা অনেকের তালিকা করেছি। দেখে বলতে পারব। তার নাম থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে জানতে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারীর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।