খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কেইউ) গণিত বিভাগের সাবেক ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান ‘মুগ্ধ’ নিছক একটি নাম নয়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার উৎখাতের আন্দোলনে তিনি শাহাদাত বরণ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়ে উঠেছেন।
কিউ শিক্ষকরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মুগ্ধ কীভাবে তিনি তার কিভাবে তার আচরণের জাদু দিয়ে পুরো ক্যাম্পাসকে বিমোহিত করে রাখতেন, অন্যদেরকে মানবিক হৃদয়বান হতে উৎসাহিত করতেন তার স্মৃতিচারণ করেছেন।
১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পানি বিতরণকালে ২৫ বছর বয়সী মুগ্ধ পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেন।
পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে একটি গুলি তার কপালে লেগে ডান কান দিয় বেরিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের অধীনে গণিত বিভাগের প্রধান প্রফেসর মো. আজমল হুদা বলেন, মুগ্ধর বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল দুর্দান্ত, যা তাকে গণিতে ভাল ফলাফল অর্জনে সহায়তা করে।
‘মুগ্ধ’ (২৫) ১৯-ব্যাচের ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক হন।
অধ্যাপক হুদা বলন, ‘তিনি (মুগ্ধ) নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ ছাত্র ছিলেন। তার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে, তিনি বিশ্বের সেরা অনলাইন কর্মক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ফাইভার-এ ৫-স্টার রেটিংসহ প্রায় ১,০০০ অর্ডার সম্পন্ন করেন।’
কেইউ শিক্ষক বলেন, মুগ্ধ জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তিনি কেই প্রোগ্রামের যে কোনো ইভেন্টে নিজেকে সেরা হিসেবে তুলে ধরেন এবং প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যে কোনো পাঠ বুঝতে এবং অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করতে সাহায্য করেন।
প্রফেসর হুদা বিষণœ কণ্ঠে বলেন, ‘১৯-ব্যাচের প্রথম দিনগুলোতে, গণিত বিভাগের সফরে আমি শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে এবং জুনিরদের দেখাশোনা করার জন্য দুজন সমন্বয়কারী নির্বাচন করতে বলেছিলাম।’
অশ্রুসজল চোখে তিনি বলেন, ‘আমি অবাক হয়েছিলাম এটা দেখে যে এই সমন্বয়ক হলেন শিক্ষকদের অন্যতম প্রিয় ছাত্র মুগ্ধ, যাকে তিনি এর আগে অনেক ইভেন্টের সমন্বয়কারী হিসাবে দেখেছেন।’
একই বিভাগের অধ্যাপক ডা. মুন্নুজাহান আরা বলেন, সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুগ্ধকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
অধ্যাপক মুন্নুজাহান বলেন, ‘গণিত বিভাগের সব শিক্ষকই তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ পছন্দ করতেন যা ছিল নির্মলতার প্রতীক।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝে যখন আমি তাকে ক্লাসে কোনো অ্যাসাইনমেন্টের বিষয়ে তিরস্কার করতাম, তখন সে হাসতো যা আমার মেজাজ ঠান্ডা করে দিতো। আশ্চর্যজনকভাবে, পরের দিন, সে তার বিখ্যাত হাসি দিয়ে তার কাজ জমা দিতো।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুঃখভারাক্রান্ত ও বিষণœ মুন্নুজাহানের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সে (মুগ্ধ) গণিত ডিসিপ্লিনের একজন উজ্জ্বল বিতার্কিক ছিলো। সে গিটার বাজাতে পছন্দ করত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগীয় অনুষ্ঠানে গিটার বাজেিয়ছে।’
তিনি আরো বলেন, মুগ্ধ খুবই বাইক চালাতে খুব আগ্রহী ছিলো। তিনি তার কিছু ছবিও দেখান।
মুন্নুজাহান বলেন, সে বাইকে চড়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘মুগ্ধকে যখন ঢাকার রাস্তায় ‘পানি লাগবে, পানি (পানি দরকার)’ বললতে বলকে পুলশের গুলিতে নিহত হতে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ি।’
কেইউ থেকে স্নাত শেষ করে মুগ্ধ এমবিএ করার জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ভর্তি হয়।
মুগ্ধর হাসিমাখা মুখের কথা মনে করে অধ্যাপক মুন্নুজাহান বলেন, মুগ্ধর সহপাঠীরা আবার বিইউপির ক্লাসরুমে ফিরে যাবে কিন্তু সে আর ফিরবে না।
মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত জানান, গুলিবিদ্ধ মুগ্ধকে তার বন্ধুরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু এর আগে সে মারা গিয়েছিল।
যারা ন্যায়সঙ্গত কারণে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত মুগ্ধ তাদের সাহায্য করতে ছাত্রদের সাথে ছিলো।
দীপ্ত বলেন, ছোটকাল থেকেই মুগ্ধ সর্বদা অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার আওয়াজ তুলেছেন।
দীপ্ত আরও বলেন, মুগ্ধ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার ছিলো। ২০১৯ সালে বনানী অগ্নিকা-ের সময় লোকদের উদ্ধার ও সরিয়ে নেওয়ায় ত্যাগী ভূমিকার জন্য মুগ্ধ বাংলাদেশ স্কাউট থেকে ‘জাতীয় পরিষেবা পুরস্কার’ অর্জন করে।