- নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন স্বতন্ত্র এমপিরা।
- ফরিদপুর—৩ আসনে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদের নেতৃত্বে নতুন এই জোট গঠনের চেষ্টা।
- শেখ হাসিনার নির্দেশনা পেলেই আত্মপ্রকাশ ঘটবে জোটের, যা হতে পারে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম – স্বতন্ত্র এমপিরা।
- বিরোধী দলে ছিলাম এবং বিরোধীদলে থাকতে চাই – জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে বিজয়ী হওয়ায় তারাই বিরোধী দল হতে যাচ্ছে বলে আলোচনা উঠেছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পর স্বতন্ত্র এমপির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবার বিরোধী দল থেকে ছিটকে পড়তে পারে জাতীয় পার্টি বা অন্য রাজনৈতিক দল।
নিয়মানুযায়ী, সংসদের আসন সংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল যাকে নেতা নির্বাচিত করবে, তিনিই বিরোধীদলীয় নেতার আসন পাবেন। তার দলই হবে সংসদের প্রধান বিরোধী দল। আর সেই নামের তালিকায় ফরিদপুর—৩ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ রয়েছেন বলে জোর আলোচনা শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র এমপিরা জোট গঠন করতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নতুন এই জোট হবে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম- এমন কথাই জানিয়েছেন স্বতন্ত্রদের নিয়ে জোট গঠনের প্রাথমিক বৈঠকে উপস্থিত একাধিক স্বতন্ত্র এমপি।
তবে গত দুটি সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবারের নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। তাদের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এ কারণে নির্বাচনে হার—জিতের নানা সমীকরণ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে ‘বিরোধী দল’ ইস্যু।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২২টি আসনে জয় পেয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপরীতে ৬২টি আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। সেই বিবেচনায় আওয়ামী লীগের পর সর্বোচ্চ ৬২টি আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নতুন দল তৈরি করে আলোচনা সাপেক্ষে বিরোধী দল গঠন হতে পারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামীলীগসহ মোট ১৫টি রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। সেই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবে বিরোধীদের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একজন করে এবং স্বতন্ত্র পাঁচজন প্রার্থী বিজয়ী হন। ওই সময় সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস।
৫১ বছর পর সেই ১৯৭৩ এর নির্বাচনের মতোই এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনি ফলাফল দেখা গেছে। বিজয়ী আওয়ামী লীগের বিপরীতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বতন্ত্র এমপিরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য নয়াকন্ঠকে বলেন, এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছেন তারা জাতীয় পার্টির চেয়ে বেশ জনপ্রিয়। যদি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোটবদ্ধ হয়ে কাউকে নেতা নির্বাচন করেন, তাহলে জাতীয় পার্টির প্রধান বিরোধী দল আর বিরোধীদলীয় নেতা পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে যদি তারা জোট বা দল গঠন না করেন, তাহলে স্বতন্ত্র থেকে বিরোধী দলীয় নেতা হওয়া সম্ভব নয়।
একাধিক স্বতন্ত্র এমপি বলছেন, নবনির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। নতুন একটি জোট বা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ঘটনের বিষয়েও আলোচনা এগিয়েছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্তও পৌঁছেছে। তার নির্দেশনার অপেক্ষা করা হচ্ছে। তবে ফরিদপুর—৩ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি এ. কে আজাদের নেতৃত্বে নতুন এই জোট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া জোটের প্রধান হিসেবে টাঙ্গাইল—৪ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র এমপি লতিফ সিদ্দিকির নামও প্রস্তাব করেছেন কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চাইলে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারবেন। আবার যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশিরভাগ স্বতন্ত্র এমপি যুক্ত, তাই তারা আওয়ামী লীগেও যোগ দিতে পারেন। এই মুহূর্তে বিষয়টি নির্ভর করছে স্বতন্ত্র এমপিদের ওপর। তারা জোট বা দল বাঁধবেন কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
বিরোধী দলের বিষয়ে একাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু নয়াকন্ঠকে বলেন, ‘সংসদের বিধি বিধান অনুযায়ী বিরোধী দল নির্ধারণ হবে।’ স্পিকার এই বিরোধীদল নির্বাচন করবেন।
ফরিদপুর—৪ আসনের নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী শপথ গ্রহণের আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আসলে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য আমরা স্বতন্ত্ররা নির্বাচন করিনি। আমরা আমাদের নিজ এলাকার যে নৌকার মাঝি তার বিপক্ষে নির্বাচন করেছি। আমরা নৌকার পক্ষেই। আওয়ামী লীগের নৌকাটা তারা ঠিকই পাইছে, কিন্তু বৈঠাটা আমরা পাইছি।
বরিশাল—৪ আসনের নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ বলেন, ‘স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শুনেছি ফরিদপুর—৩ আসন থেকে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য এ কে আজাদকে (স্বতন্ত্র) নিয়ে জোট হতে পারে। তবে আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা সেটাই করবো। আমাদের সিদ্ধান্ত আপার ওপর।’
এদিকে একাধিক স্বতন্ত্র এমপির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত হওয়ায় নিজেরা একক কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। সেই হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোট বা দল গঠন করবেন কিনা— তা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, স্বতন্ত্ররা জোট করে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচন করলে তাতে বাংলাদেশের আইনে কোনো বাধা নেই। আইনত এটা ‘সম্ভব’। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পাওয়া একাধিক স্বতন্ত্র এমপিরা বলেছেন, তারা শপথ নেওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বসবেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সেরকম হলে গত দুই সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি সেই তকমা হারাতেও পারেন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) বলেন, “আমি ঠিক জানি না নিয়মটা কি। তবে আমরা বিরোধী দলে ছিলাম, এবং বিরোধীদলে থাকতে চাই। আমরা জনকল্যাণমুখী, যেটা জনগণের ভালো হয় সেটিই আমরা করতে চাই।”