রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায় জামায়াতে ইসলামী। এর ফাঁকে সারা দেশে সংগঠন গুছিয়ে নিতে চায়। জনসমর্থন বাড়াতে ইতিমধ্যে চোখে পড়ার মতো সামাজিক ও মানবিক কাজ করছে দলটি। নেতাকর্মীরা মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন মানুষের মৌলিক অধিকার ও সাম্যের সমাজ গঠনের ওপর। নির্বাচনের ইস্যু আপাতত জামায়াত দূরে রাখতে চায়। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে থাকলে এককভাবেও নির্বাচন করার চিন্তা আছে দলটির। জামায়াতের বিভিন্ন সারির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েছে বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত উপদেষ্টার ভাষণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। দলটির রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ চেয়েছে। উপদেষ্টার ভাষণে রোডম্যাপ না থাকায় নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি বলে মনে করছে বিএনপি। দল দুটির দুই ধরনের বক্তব্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। যদিও জামায়াত বলছে এর জেরে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ফাটল ধরবে না।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছি। তারা যতদূর সম্ভব প্রশাসন, আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এ সময়টুকু তাদের দিতে হবে। এগুলোতে এখনও ফ্যাসিবাদী লোকজন বসে আছে। তাদের না সরিয়ে নির্বাচন দিলে নিরপেক্ষ হবে না।
ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আশরাফুল আলম বলেন, আমরা এতদিন সরকার ও প্রশাসনের বাধায় দলকে ফোকাস করতে পারিনি। এখন সময় এসেছে দলের কার্যক্রম সবার সামনে তুলে ধরার। প্রথমত, আমরা সংগঠনকে আরও মজবুত করতে চাই। আর নির্বাচনের বিষয়টি পরে আসবে। কেননা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এখনও আমাদের দলের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত; পঙ্গুত্ববরণ করেছে। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের প্রস্তুতি সবসময় আছে। আমরা ২০২৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ১৫০ আসনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকাও তৈরি করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে একতরফা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব নেই। তারা তাদের রাজনীতি করছে; আমরা আমাদের কাজ করছি। তবে আমাদের চিন্তা এককভাবে নির্বাচন করার।
জামায়াতে ইসলামীর উত্তরের এক নেতা বলেন, সাধারণ মানুষের চাওয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে জামায়াত। কোনো দখলদারি সমর্থন করে না। আমরা এখন ত্রাণ কার্যক্রম ও আন্দোলনে শহিদ পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছি। সাংগঠনিক ও দাওয়াতি কাজে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারকে সময় দিতে হবে। কারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের পর্যাপ্ত সময় দরকার। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করা না করার বিষয়টি নির্বাচনের আগে সামনে আসবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। দুয়েকটি বক্তব্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় না।
কেন্দ্রীয় আরেক নেতা বলেন, পতিত সরকারের আমলে বিএনপি বা অন্য বিরোধীরা সভা-সমাবেশ করার কিছু সুযোগ পেয়েছে। আমাদের সেই সুযোগ একেবারে ছিল না। বাধ্য হয়ে অনেক কাজ আড়ালে করতে হয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে সংগঠনকে মেলে ধরার। প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কাজে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। এ বছরই আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা। এর জন্য ব্যস্ততা আছে। সারা দেশে দাওয়াত, দায়িত্বশীলদের সভা, সমর্থক সংগ্রহ, জনশক্তি তৈরি, জনশক্তির মানোন্নয়ন ও কর্মী বাড়ানোর মতো বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। দলের আর্থিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় এসব নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সারা দেশের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কোটা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে। সংগঠনকে মজবুত করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দিনাজপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ড. এনামুল হক বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্তের কথা বলতে পারব না। তৃণমূলে আমরা স্বাভাবিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নতুন কর্মী কিংবা জনশক্তি বাড়ানোর তৎপরতা আগের মতোই আছে। সামাজিক কার্যক্রমও চলছে। নতুন কোনো নির্দেশনা নেই।
১৯৯৯ সাল থেকে জোটবদ্ধ বিএনপি ও জামায়াতের জোট ২০২২ সালে ভেঙে যায় বলে সে বছরের অক্টোবরে একটি রুকন সম্মেলনে প্রকাশ করেন শফিকুর রহমান। পরে ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল স্বীকার করেন, তারা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছেন। তবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল, যুগপৎ কর্মসূচিও দিয়েছে দুই দল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সঙ্গে ও বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক করেছে, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গেছে, চার দিন পর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন দেবে-এ প্রশ্নে এখন বিএনপি ও জামায়াত বিপরীতমুখী অবস্থানে। গত ২৪ আগস্ট ফখরুল হঠাৎই বলেন, ‘কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে’ তার বিশ্বাস নেই। তিনি নির্বাচন নিয়ে দ্রুত সংলাপের দাবি জানান। কয়েক দিন আগে ‘বন্যার আহাজারির মধ্যে একটি দল নির্বাচন, নির্বাচন জিকির করছে’ বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। এর জবাব দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, সে ধরনের দলকে সমর্থন করা যাবে না।